হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে স্বর্ণ ও মাদকদ্রব্য চোরাচালানের নিরাপদ রোড। পাচারকারী চক্রের সদস্যরা কৌশলে স্বর্ণ ও মাদকদ্রব্য পাচার করছে। গত দেড় বছরে প্রায় এক মণেরও বেশি সোনা ও মাদকদ্রব্য জব্দ করা হয়েছে। এসব অবৈধ সোনা ও মাদকের আনুমানিক বাজার মূল্য কয়েকশ’ কোটি টাকা। কয়েকশ কোটি টাকার স্বর্ণ ও মাদক উদ্ধার করলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে পাচারকারী চক্রের মুলহোতা। এতে করে কোনভাবেই নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না স্বর্ণ ও মাদক পাচার।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পৃথক এসব ঘটনায় বাংলাদেশ বিমানের প্যান্ট্রিম্যান শাহিনুর ও রুহুল আমিন, নিরাপত্তা কর্মী ইব্রাহীম খলিল ও যাত্রী কামাল উদ্দীনসহ অসংখ্য যাত্রী ও সোনা পাচারকারীকে আটক করেছে আইনশৃংলা বাহিনী। পরে তাদের বিমানবন্দর থানায় সোপর্দ করা হয়। এছাড়া সন্দেহভাজন হিসেবে ছয় জনকে আটক করা হয়েছে। তারা হলেন-বাংলাদেশ এক্সপ্রেস লিমিটেড এর এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর (অর্থ) খন্দকার ইফতেখার উদ্দিন আহমেদ (৫০) ও সিনিয়র ম্যানেজার (অপারেশন) রাসেল মাহমুদ (৩২)। ইউনাইটেড এক্সপ্রেস এর জেনারেল ম্যানেজার গাজী শামসুল আলম (৪৩)। ইক্সপোর্ট কার্গোর ভেতরে এমজিএইচ গ্রুপের লোডিং সুপারভাইজার কাজল থুটোকিশ গোমেজ, কার্গো হেলপার/লোডার মো. হামিদুল ইসলাম (৩০) ও মো. নজরুল ইসলাম। তার মধ্যে আটক কামাল উদ্দীন সোনা পাচারের একজন বাহক। বিগত প্রায় দেড় বছরে বিমানবন্দরের অ্যাপ্রোন (অ্যাপ্রন সাইড), লাগেজ বেল্ট, প্রবেশ গেইট ও চেকিং এলাকা সহ বিভিন্ন এলাকায় পৃথক অভিযান চালিয়ে তাদেরকে আটক করা হয়।
খোঁজ নিয়ে ও বিভিন্ন তথ্য সূত্রে জানা গেছে, বিগত বছর গুলোতে ১২ কেজি ৩২০ গ্রাম ওজনের প্রায় ২৪ কোটি ৬৪ লাখ টাকা মূল্যের অ্যামফিটামিন পাউডার (মাদক) জব্দ করা হয়েছে। জিন্সের প্যান্টের আড়ালে কার্টনের গায়ে ১৪টি বড় প্যাকেট ও ১৪টি ছোট প্যাকেটে মোট ২৮টি কার্বনের লেয়ার দ্বারা প্রস্তুত পাতলা অ্যালুমিনিয়াম প্যাকেট উদ্ধার করা হয়। আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সার্ভিস ফেডেক্সের মাধ্যমে নিষিদ্ধ মাদক অ্যামফিটামিন পাউডার পাঠানো হচ্ছিলো অস্ট্রেলিয়ায়। বাংলাদেশ থেকে হংকং হয়ে অস্ট্রেলিয়া পাঠানো হচ্ছিল।
সূত্র জানায়, ২০০৮ সালে ১৬ মার্চ ৯ কেজি ৪০০ গ্রাম ৮০ পিস সোনা আটক করা হয়। যার আনুমানিক বাজার মূল্য পৌনে ৫ কোটি টাকা, ২০২২ সালের ২৭ জানুয়ারি ৩০ পিস ৩.৪৮০ গ্রাম সোনা জব্দ করা হয়। যার মূল্য প্রায় ২ কোটি ১৫ লাখ টাকা, এছাড়া বিপুল পরিমাণ পেস্ট গোল্ড, চুড়ি ও জুয়েলারি গুল্ড রয়েছে। পাশাপাশি কয়েক হাজার দামি মোবাইল ফোনও জব্দ করা হয়েছে।
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের এক কর্মকর্তা জানান, বিমানবন্দরে রফতানি কার্গো ভিলেজে ডুয়েল ভিউ স্ক্যানারে নিরাপত্তা তল্লাশি বা স্ক্রিনিংয়ের সময় গার্মেন্ট পণ্যের (জিন্স প্যান্ট) কার্টনে ভর্তি অবস্থায় এসব মাদক পাউডার জাতীয় পদার্থ পাওয়া যায়। মূলত ইয়াবা তৈরির উপাদান দিয়ে কোকেন সদৃশ্য এই মাদক তৈরি করা হয়েছে। হংকং হয়ে অস্ট্রেলিয়াগামী বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে তা হংকংয়ে পাঠানোর উদ্দেশ্য ছিলো।
বিমানবন্দর সূত্র আরো বলছে, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পাশাপাশি বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোয় খাবার পরিবেশন ও কেবিন ড্রেসিংয়ের দায়িত্ব পালন করে বিমান ফ্লাইট ক্যাটারিং সেন্টার-বিএফসিসি। প্রয়োজনীয় খাবার ফ্লাইটে পৌঁছে দিতে কর্মীরা ব্যবহার করেন বিমানবন্দরের অ্যাপ্রোন এলাকার লাগোয়া বিএফসিসির পেছনের গেট। এ সুযোগে হাতবদল করা হয় চোরাচালানের বিভিন্ন পণ্য। পরে বিএফসিসির সামনের গেট হয়ে চত্বরের বাইরে চলে আসে সেসব স্বর্ণ। এসব কর্মকাণ্ড করতে গড়ে উঠছে একটি সিন্ডিকেট। এ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চালানো হচ্ছে তাদের অপকর্ম।
সূত্র আরো বলছে, দুর্বল নিরাপত্তা ব্যবস্থা, অপর্যাপ্ত নিরাপত্তাকর্মী, অপরিসর নিরাপত্তা গেট ও নিজস্ব লোক দিয়ে নামমাত্র চেকিংয়ের সুযোগে বিএফসিসিতে গড়ে উঠেছে সোনা পাচারের নিরাপদ স্থান। দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন পর্যায়ের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর সিন্ডিকেট এই পথে নির্বিঘ্নে পাচার করছে সোনা। বিমানের তদন্ত প্রতিবেদনেই উঠে এসেছে এসব তথ্য।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিভিন্ন সময় পাচারের স্বর্ণসহ বিমানের কর্মী আটক হলেও মূল অপরাধীরা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। এবারের তদন্ত প্রতিবেদনেও তাদের শাস্তির আওতায় আনার সুপারিশ নেই। গত ২ সেপ্টেম্বর বিমানের পেন্ট্রিম্যান (সিসি-৩৯২) জাহাঙ্গীরের দেহ তল্লাশি করে স্বর্ণবার উদ্ধারের ঘটনায় ৪ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে বিএফসিসি।
এ সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চোরাচালান বন্ধে নিরাপত্তা গেট বড় করা ও নিরাপত্তাকর্মী বাড়াতে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে একাধিক মিটিংয়ের পরও ব্যবস্থা না নেয়ার অভিযোগ এসেছে। তদন্তে ১৮ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের পর জাহাঙ্গীরসহ দু’জন অভিযুক্ত ও পাঁচজন সন্দেহভাজনকে চিহ্নিত করে কমিটি। বিএফসিসিকে ঘিরে চোরাচালানসহ বিভিন্ন অভিযোগে বিএফসিসি প্রশাসনের পর বিমান প্রশাসনেরও দুই সদস্যের কমিটির তদন্ত চলছে।
এব্যাপারে নিরাপত্তা জোরদারের পাশাপাশি কঠোর নজরদারির প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বর্তমান সরকারের প্রধান উপদেষ্টা সহ সংশ্লিষ্ট মহলের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন এলাকাবাসী প্রবাসী যাত্রীরা।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের জনসংযোগ কর্মকর্তা শেখ মো. খালিদুল করিম জানান, আমরা বাংলাদেশে অবস্থিত ইন্টারন্যাশনাল কুরিয়ার সার্ভিসগুলোর উপর নজরদারি রাখছি। কেউ যাতে কোনোভাবে মিথ্যে তথ্য দিয়ে কুরিয়ার সার্ভিসকে ব্যবহার করে বিভিন্ন পণ্যের আড়ালে মাদকের চোরাচালান করতে না পারেন। এই মাদক বাংলাদেশে উৎপাদন হয়না। তবে পার্শ্ববর্তী মিয়ানমার ও চীন উৎপাদন করে থাকে। সেখান থেকে কোনো না কোনোভাবে এটি বাংলাদেশে আসতে পারে। এই আন্তর্জাতিক পাচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এবিষয়ে কাউকে বিন্দুমাত্র ছাড় প্রদান করা হবে না।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

গড়ে উঠছে শন্তিশালী সিন্ডিকেট, ধরাছোঁয়ার বাইরে পাচারকারী চক্রের মুলহোতা
বিমানবন্দর স্বর্ণ ও মাদকদ্রব্য চোরাচালানের নিরাপদ রোড
- আপলোড সময় : ১৪-১০-২০২৪ ১২:২৬:৩০ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ১৪-১০-২০২৪ ১২:২৬:৩০ পূর্বাহ্ন


কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ